এক সোনালী বিকেলের শেষ প্রান্ত-সমস্ত দিনের ব্যস্ততা শেষে পিঁপড়ের সারির মত ধীরে ধীরে ঘরে ফেরে মানুষের দল। আব্দুল গালিব, একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ঘরের কাছে হিজল তলায় বেঞ্চিতে বসে জীবনের হিসেব মিলায়। দিগন্তে নিথর দৃষ্টি তার; আধপাকা চুলগুলো ঝিরঝির বাতাসে দুলছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে সে অপার্থিব কোন ভাবনায় নিমগ্ন। "বলি আর কত জ্বালাবেন। এই বয়সেও সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবনটা শেষ করে ফেললাম। নিজের তো পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই।" কথাগুলো বলতে বলতে স্ত্রী এক কাপ চা আর কিছু মুড়ি রেখে গেলেন পাশে। স্ত্রীর এ ধরনের রূঢ় আচরণই আব্দুল গালিবের কাছে সেই পঁচিশ বছর বয়সের প্রথম প্রেমের গভীর কাব্য বলে মনে হয়। ভেতরের হাসিটা চেপে রাখতে পারেন না; কারণ এখন সে জানে এ ধরনের কথা বললেই যে তার স্ত্রীর মন খারাপ তা নয়। সময় পেলে হিজল গাছের তলায় আব্দুল গালিব এভাবেই বসে থাকেন; মধ্য বয়সের একটা বেদনার স্মৃতি বুকে আগলে রেখে এখনও কাঁদেন। এক সময় তার মেয়ে এনি এই গাছের ডালে ঝুলেই জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। কিছু বখাটে ছেলে এনির পিছনে ঘুর ঘুর করতো। লোকলজ্জার ভয়ে সে কাউকে কিছু বলতো না। এনি যখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল তখন বাবা তার কাছ থেকে সবকিছু জেনেছেন। তিনি সে বখাটে ছেলেদের অভিভাবকদের কাছে নালিশ জানালেন। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই হিজল গাছের ডালে এনির ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেল। আব্দুল গালিবের কাছে কেবলই মনে হয় তার ভুলের কারণেই তার মেয়েকে প্রাণ দিতে হল। এখন তিনি গাছটার সাথে বিড় বিড় করে সারাক্ষণ কথা বলেন। বাতাসের শব্দের মত আজও তার মেয়ের ছায়া টের পান আর ভেতর থেকে অহেতুক কান্না বেড়িয়ে আসে। আব্দুল গালিব তাই পৃথিবীটাকে আর পাঁচটি মানুষের মত রঙিন ভাবতে পারেন না। এখন একমাত্র ছেলে হিমেল তাদের সুখ দুঃখ স্বপ্ন সবকিছু। চাকরীর কারণে ছেলেবৌ, নাতি, নাতনিসহ ঢাকাতেই থাকতে হয় তাকে। বাবা মা'কে নিয়ে একসাথে থাকার প্রবল আগ্রহ, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ আর একান্তই নিজের কিছু ভাবনা সব মিলিয়ে জীবনের সহজ সমীকরণগুলো জটিল হতে থাকে। একাধিকবার সে তার বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে একসাথে থাকার জন্য, কিন্তু প্রতিবারই সে আশা ভেঙে গেছে। তারা যেমন গ্রামে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অন্য দিকে হিমেলের স্ত্রী ঠিক যেন মন থেকে চায় না শ্বশুর শাশুড়ির সাথে থাকতে। তাদের ভেতরের এই অদৃশ্য দেয়াল হয়ত চিরকালীন হয়ত এ কারণেই ভেতরে ভেতরে জ্বলে যায় হিমেল। অথচ গ্রামে বাবা মা'র কাছে যাওয়ার অবসর নেই। বলা যেতে পারে আধুনিক নগরকেন্দ্রিকতা অথবা বাস্তবতা তাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই হিমেলকে তাই কখনও কোনও গভীর রাতে বেলকুনিতে দেখা যায় পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনও সে রাতের আকাশে রাস্তায় পড়ে যাওয়া ছড়ানো ছিটানো মুড়ির মত তারার দিকে চেয়ে থাকে আর কিছু ব্যর্থতা স্মৃতির ভাজে অহেতুক কষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। সব শেষ যেদিন তার বাবা মা ঢাকায় এলেন হিমেল আপ্রাণ চেষ্টা করলো তাদেরকে খুশী রাখতে। হিমেলকে প্রতিদিন অফিস করে অনেক রাতে বাসায় ফিরতে হয়। নাতি নাতনি দুজন দিনে স্কুলে তারপর বাসার শিক্ষকদের কাছে পড়তে বসে। সন্ধ্যে হলে মা বসেন পড়াতে। পাড়া প্রতিবেশী কারো সাথে কেমন যেন আন্তরিকতা বা প্রীতির বন্ধন নেই। আব্দুল গালিবের কাছে কেবলই মনে হয় এই বিধ্বস্ত শহরে হাজারো মানুষের ঢল যেন সমুদ্রের স্রোতে ভাসমান কচুরিপানার মত উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। সমস্ত দিনের ব্যস্ততার কোলাহল ঘিরে থাকে অথচ বড় একা লাগে; শিশিরের শব্দের মত নিঃসঙ্গতা ভরে থাকে সারাক্ষণ। তাই একদিন সবার সম্মুখেই আব্দুল গালিব হিমেলকে বললেন- "বাবা, যে যেখানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাকে সেখানেই থাকতে দেয়া উচিত। এই বৃদ্ধ বয়সে কেন খাঁচায় বন্দি করে রাখতে চাও। গ্রামেই শান্তি।" হিমেল হতাশার চোখে বাবা মা'র দিকে তাকায় আর বলে- "বাবা, গ্রামে তোমাদের কে দেখাশুনা করবে বলো। এখানে তোমাদের কোন অসুবিধে হলে বল।" "এমন করে কথা বল যেন আমরা তোমাদের কোন আচরণে কষ্ট পাচ্ছি। আসলে আমরাই এখানে মানাতে পারছি না। তুমি যদি সময় করতে পার তাহলে মাঝে মধ্যে আমার নাতি নাতনি দুটো নিয়ে গ্রামে এসো। ওদের জন্যই বেঁচে আছি আর মনটা ছটফট করে সারাক্ষণ।" -কথাগুলো বলতে বলতে আব্দুল গালিবের চোখে জল এসে যায়। বাবা মা'কে আর ধরে রাখা গেল না। তাদেরকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিয়েছে হিমেল। ওষুধগুলো ঠিকমত খাওয়ার জন্য অনেকবার তাগাদা দিয়ে রেখেছে সে। তারপর অনেক দিন হল কেবলই মনে হয় জীবনের কোন একটা অংশ ফাঁকা পড়ে আছে; যে শূন্যতা কখনও কখনও হাহাকার করে ওঠে হৃদয়ের গভীরে। ক্লান্ত পথিকের মত কি যেন খুঁজে খুঁজে দিশেহারা দুটি চোখ আবার হামেশাই মিশে যায় ব্যস্ততার ভিড়ে। গ্রামে আব্দুল গালিবকে এখন আর পাঁচ জন মানুষের মতই বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে দেখা যায়, কখনও দেখা যায় বাজার করতে আবার ঘরে বৃদ্ধা স্ত্রীর সাথে তরকারী কুটতে কিংবা রান্না করতে। এই বয়সে শরীরে শক্তি নেই। দেখা যায় সামনের দোকান থেকে সদায় আনতে পাঁচ মিনিটের পথে তার এক ঘণ্টা লেগে যায়। বেখেয়ালে প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডায় মেতে ওঠে। এ জন্য প্রায়ই তাকে অনেক কথা শুনতে হয় স্ত্রীর কাছে। সবকিছুর মাঝেও কখনওবা একে অপরের প্রতি নির্ভরতা আর কোন এক গভীর প্রেমের টান অনুভব করে। দুজনার কথার ফাঁকে বার বার ছেলে, নাতি, নাতনির সুখকর স্মৃতির দৃষ্টান্ত চলে আসে। গেল ঈদে হিমেল গ্রামে আসেনি হয়ত কাজের ধকল যাচ্ছে, হয়ত অনেক কষ্টে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্দুল গালিব পথে ঘাটে সকলের সাথে শুধু বলে বেড়ান- "অনেক কাজের ঝামেলায় আছে আমার হিমেল, এবার বাড়ি আসতে পারেনি, কয়েক দিন পরে আসবে।" অন্য কোন ছুটিতে না হলেও ঈদ পার্বণগুলো হিমেল অবশ্যই বাবা মা'র সাথে কাটায়- আর এ কারণেই একটা ঈদ চলে গেলে ছেলের প্রতীক্ষায় দিন গুনতে থাকে বয়সের ভারে ক্লান্ত বাবা মা। আশায় আশায় থেকে ছেলের আসার মত আরো কয়েকটা পার্বণ কেটে গেল। তবুও প্রতীক্ষায় থাকে- হয়ত অনেক ঝামেলায় আছে হিমেল, হয়ত সে আসবে সবাইকে নিয়ে। আব্দুল গালিবের শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। আশপাশের লোকেরা তার অসুস্থতার কথা জানলেও সবাই তাদেরকে এড়িয়ে যেতে চায়-হয়ত তাদের কথাবার্তা এখন অসংলগ্ন, অনেক পুরনো অথবা একঘেয়ে। ইদানীং আব্দুল গালিব ও তার স্ত্রীকে প্রায়ই দেখা যায় হিজল গাছের তলায়। কোন এক প্রতিবেশী কোন এক সময়ে দেখলো-বৃদ্ধা স্ত্রী তার স্বামীর মাথায় পানি ঢালছেন পরে আচল দিয়ে মাথা মুছে দিচ্ছেন আবার তাকে আগলে ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। অতঃপর একদিন গভীর রাতে ঘরের মধ্য থেকে আব্দুল গালিবের স্ত্রীর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল, যে আওয়াজটা ছিল অস্বাভাবিক অথবা কাউকে হারানোর হৃদয়ের ভেতরের কান্না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপসকিরণ রায়
সুন্দর কাব্যময় গল্পটি পড়লাম--জানা কাহিনী হোলেও লেখার গুণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।বৃদ্ধ বাবা মার শেষ পরিণতিতে মন ব্যথিত হয়ে ওঠে।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই,ভাই !
তানি হক
আমাদের বাস্তব জীবনের এক বেদনা বিধুর চিত্র একেছেন ভাইয়া ...এমন গালিব সাহেব...এবং তার সন্তান ..জীবনের এক নিস্সঙ্গ মুহুর্ত্য ..জীবনের কঠিন রীতি ..অনেক অনেক কিছুই উঠে এসেছে গল্পে যা আমাদের ই তৈরী বাস্তবতা .. গালিব সাহেবের এই কষ্ট সত্যি মেনে নেয়া কঠিন ..আর মেনে নিতে চাই ও না ..যে জীবন ..আমাদের আত্তার সম্পর্কর সাথে ..বন্ধন ছিন্ন করে ..সেই জীবন চাইনা...সেই জীবনের দরকার নেই .. :( আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ভাইয়া ..এই গল্পটি আমাদের বিবেক জাগ্রত করবে ..
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
অনেক সুন্দর গল্পের প্লপ....গল্প বলার বা লেখার সতন্ত্র দক্ষতা একজন লেখককে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে ....সে ক্ষেত্রে আপনি সফল হয়েছেন.....কবির ভাই আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ........................
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।